পেয়ারা চাষের পদ্ধতি
পেয়ারা চাষ
পেয়ারা (Psidium guajava) একটি জনপ্রিয় ফল, যা তার সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর
গুণের জন্য সারা বিশ্বে খাওয়া হয়। এই ফলটি বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং
অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে পেয়ারা চাষ করা হয়, বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা,
বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী জেলায় এর চাষ প্রচলিত। এখানে পেয়ারা চাষের
পদ্ধতি ও কার্যক্রম আলোচনা করা হলো :
পেয়ারা গাছ শীতপ্রধান, উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালোভাবে জন্মে। গাছটি এমন
মাটিতে ভালো ফলন দেয়, যা জল নিষ্কাশনযোগ্য ও হালকা ক্ষারযুক্ত। পেয়ারা গাছ
মূলত সমতল এবং উঁচু জায়গায় চাষ করা হয়। এতে ভালো বায়ু চলাচল নিশ্চিত হয় এবং
গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।
উপযুক্ত আবহাওয়া:
তাপমাত্রা: ২০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস
আর্দ্রতা: ৬৫%-৮০%
বৃষ্টিপাত: বার্ষিক ১৫০০-২০০০ মিমি
মাটি:
সঠিক পিএইচ মান: ৫.৫-৭.৫
মাটি: দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি
পুষ্টি উপাদান: অর্গানিক উপাদান সমৃদ্ধ, জল নিস্কাশনযোগ্য মাটি
২. পেয়ারা গাছের চাষের জন্য বীজ নির্বাচন ও বপন
পেয়ারা চাষের জন্য প্রথমত ভালো মানের বীজ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বীজগুলো সুস্থ, সুষম এবং পরিপক্ক হওয়া উচিত।
বীজ নির্বাচন:
বীজ সংগ্রহ করতে হবে পূর্ণাঙ্গ, স্বাস্থ্যবান, রঙিন এবং পরিপক্ক পেয়ারা ফল
থেকে।
বীজ অবশ্যই কোন রোগবালাই মুক্ত হতে হবে।
বীজ বপন:
বীজ বপন করার আগে সেগুলো একদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা উচিত, যাতে বীজ দ্রুত
অঙ্কুরিত হয়।
বীজ বপনের জন্য বাচ্চা গাছ তৈরি করার জন্য পট বা মাটির বাক্স ব্যবহার করা
হয়।
মাটির গভীরতা ১-১.৫ ইঞ্চি হতে হবে।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশে ধান চাষের পদ্ধতি
৩. পেয়ারা গাছের পুঁতে দেয়া (Transplantation)
পেয়ারা গাছের সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গাছগুলো শুরুতে ভালোভাবে
বৃদ্ধি পাওয়া দরকার। ৩-৪ মাস পর বীজ থেকে চারা তৈরি হলে এগুলো মূল স্থানে
রোপণ করা হয়।
পুঁতে দেয়ার পদ্ধতি:
গর্তের আকার: ২ ফুট × ২ ফুট × ২ ফুট
গর্তের মধ্যে এক ধরনের ভারী সারের মিশ্রণ করা হয়, যাতে গাছের জন্য পুষ্টি
সহজলভ্য হয়।
চারাগাছ স্থায়ী জায়গায় ৬ ফুট দূরত্বে রোপণ করা হয়।
৪. পেয়ারা গাছের পরিচর্যা
পেয়ারা গাছের ভালো ফলন পেতে নিয়মিত পরিচর্যা প্রয়োজন। এই পরিচর্যা মূলত
মাটি, সেচ, সার, এবং রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করে।
সেচ:
পেয়ারা গাছের জন্য সেচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বৃষ্টির মৌসুমে সেচ কম
করতে হবে।
শীতকাল এবং বর্ষার মৌসুমে সেচ কম দেয়া উচিত, তবে গরমকাল ও শুকনো মৌসুমে
নিয়মিত সেচ দিতে হবে।
সার প্রয়োগ:
পেয়ারা গাছকে বছরে ৩-৪ বার সার প্রয়োগ করতে হবে।
প্রথম সার প্রয়োগ করা হয় রোপণের পর ৩-৪ মাসে। তারপর প্রতি ২-৩ মাস পর সার
দেয়া হয়।
প্রতি গাছের জন্য গাছের বয়স অনুযায়ী ২৫০-৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম
টিএসপি, এবং ১৫০ গ্রাম এমওপি সার ব্যবহার করা যেতে পারে।
মাটি চাষ:
গাছের চারপাশে নিয়মিত মাটি চাষ করতে হবে যাতে মাটির উপরিভাগের আর্দ্রতা বজায়
থাকে এবং জমির বায়ু চলাচল বাড়ে।
৫. পেয়ারা গাছের ছাঁটাই
গাছের ভাল বেড়ে উঠতে এবং ফল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নিয়মিত ছাঁটাই প্রয়োজন।
গাছটি যেন ভালোভাবে শাখা প্রশাখা তৈরি করতে পারে, তার জন্য দরকারি শাখাগুলো
ছাঁটাই করতে হয়।
ছাঁটাইয়ের সময়:
গাছ যখন ৬-৭ মাস বয়সী হয়, তখন থেকে নিয়মিত ছাঁটাই শুরু করা উচিত।
শুকনো, ক্ষতিগ্রস্ত শাখাগুলো অপসারণ করতে হবে।
৬. পেয়ারা গাছের রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ
যেমন অন্যান্য ফলগাছের ক্ষেত্রে, পেয়ারা গাছেও কিছু সাধারণ রোগ ও পোকামাকড়ের
আক্রমণ হতে পারে।
সাধারণ রোগ:
পানি পচা রোগ: অতিরিক্ত সেচ বা বর্ষায় মাটির জল নিষ্কাশন না হওয়ার কারণে এই
রোগ হতে পারে।
পাপড়ি পোকার আক্রমণ: পিপঁড়া ও অন্যান্য পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষা
করতে পেস্টিসাইড ব্যবহার করা যায়।
ব্রাউন রোট: গাছের শাখায় ব্রাউন রোট দেখা দিলে ওই শাখাগুলো চিহ্নিত করে
অপসারণ করা উচিত।
৭. পেয়ারা ফল সংগ্রহ
পেয়ারা গাছের ফল সংগ্রহের জন্য সাধারণত গাছের বয়স ২-৩ বছর হতে হয়। ফল পাকা
হলে গাছ থেকে কেটে সংগ্রহ করা হয়। পাকা পেয়ারা হালকা হলুদ বা সাদা রঙের হয়ে
থাকে।
ফল সংগ্রহের সময়:
পেয়ারা ফল সাধারণত ৪-৫ মাস পরপর পাকে, তবে এটি গাছের জাত, আবহাওয়া এবং
পরিচর্যার ওপর নির্ভর করে।
এক্ষেত্রে, পরিপূর্ণ পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে, কারণ অপরিপক্ব ফল খাওয়ার
উপযোগী হয় না।
৮. পেয়ারা চাষের লাভজনকতা
পেয়ারা চাষে লাভবান হওয়ার জন্য কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। ভালো মানের বীজ,
সঠিক পরিচর্যা, উপযুক্ত মাটি, সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ, এবং রোগ বালাই
নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিলে ফলন বাড়ানো সম্ভব।
লাভ:
পেয়ারা একটি দ্রুত বর্ধনশীল ফল, যা ৩-৪ মাস পরপর ফল দিতে শুরু করে।
পেয়ারার বাজারমূল্য ভাল, যা চাষিদের জন্য একটি লাভজনক ব্যবসা হতে
পারে।
###
পেয়ারা চাষ একটি লাভজনক কৃষি ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যদি সঠিক
নিয়মে চাষ করা হয়। উপযুক্ত আবহাওয়া, মাটি, সার প্রয়োগ, এবং নিয়মিত পরিচর্যার
মাধ্যমে পেয়ারা গাছের ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক ফল
সংগ্রহের পদ্ধতি মেনে চললে চাষিরা লাভবান হতে পারে এবং পেয়ারা চাষে কৃষকদের
আয় বৃদ্ধি পেতে পারে।
জাহিদ হেল্প কেয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url